রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৩৬ পূর্বাহ্ন
সরকারের মাঠ প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা, অতিরিক্ত সচিব, সিলেট বিভাগীয় কমিশনার মো. মশিউর রহমান এনডিসি বৃহস্পতিবার (২ জুলাই) সকাল ১০টায় উপজেলা পরিষদ সম্মেলন কক্ষে এই তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সেখানে খামার মালিক দীনবন্ধু সেন, সহযোগী শাহাজান মিয়াসহ বাদী পক্ষের লোকদের সাক্ষ্যগ্রহণ ও বিবাদী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ মোঈদ ফারুকের স্বাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। এরপর সাক্ষীদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়।
এছাড়া এই ঘটনায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জুড়ী থানার ওসি (তদন্ত) মো. আমিনুল ইসলামেরও সাক্ষ্য নেওয়া হয়। শুনানি শেষে বাদী-বিবাদীদের নিয়ে উপজেলার পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়নের আমতৈল গ্রামে আলোচিত ‘বন্ধু পোলট্রি খামার’ পরিদর্শন করেন বিভাগীয় কমিশনার মো. মশিউর রহমানসহ অন্যান্যরা।
তদন্তকালে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব ও পরিচালক, স্থানীয় সরকার) মো. ফজলুল কবীর, মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তানিয়া সুলতানা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল-ইমরান রুহুল ইসলাম, জুড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম সরদার প্রমুখ।
তদন্ত কাজ শেষে সিলেট বিভাগীয় কমিশনার মো. মশিউর রহমান এনডিসি গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, বিষয়টি তদন্তের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে ইতিমধ্যে চিঠি পেয়েছি। মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে তদন্ত করে প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য। সেই মোতাবেক আমি সরেজমিন এসে তদন্ত করেছি। আমি আমার প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেব, এরপর মন্ত্রণালয় তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এর বাইরে আমার কিছু বলার নেই।
বিবাদী পক্ষের সামনে বাদীপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ নেওয়ায় বিচার প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে কোনো ব্যাঘাত ঘটবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, সাক্ষি নেওয়ার প্রক্রিয়াটাই তাই। বিবাদীর সামনে সাক্ষি নিতে হবে। বিষয়টি আড়ালে নেওয়ার কিছুই নেই। বাদী যখন বিচার চাইছেন তাই সাক্ষির সামনেই দিতে হবে। এটাই হলো আইনগত প্রক্রিয়া।
প্রসঙ্গত, গত ২১ জুন সিলেট বিভাগীয় কমিশনার মো. মশিউর রহমান এনডিসি সাক্ষরিত একটি চিঠি উপজেলা চেয়ারম্যান এম এ মোঈদ ফারুকের কাছে পাঠানো হয়। সেই চিঠির প্রেক্ষিতে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ মোঈদ ফারুকের বিরুদ্ধে ১৮ মে স্থানীয় সরকার বিভাগের সূত্রোল্লিখিত স্মারকে উল্লিখিত অভিযোগ/অপরাধের বিষয়ে তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। এর আগে ৫ মে জেলা প্রশাসক মৌলভীবাজার এর স্মারকের সূত্র ধরে উপজেলা চেয়ারম্যানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
এরই প্রেক্ষিতে উপজেলা চেয়ারম্যান মন্ত্রণালয়ে তাঁর জবাব পাঠান। কিন্তু মন্ত্রণালয়ে পাঠানো তাঁর কারণ দর্শানোর জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় তাকে স্বীয় পদ থেকে অপসারণের লক্ষ্যে তদন্ত প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য ১৮ মে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের (উপজেলা-২ শাখা) উপসচিব মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম সাক্ষরিত একটি চিঠি সিলেট বিভাগীয় কমিশনারকে পাঠানো হয়।
স্থানীয় সরকার বিভাগ, জেলা প্রশাসক মৌলভীবাজার চিঠির সূত্রে জানা যায়, গত ১ মে রাত ১০টায় মদ্যপ অবস্থায় জুড়ী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ মোঈদ ফারুকের নেতৃত্বে একটি সংঘবদ্ধ দল উপজেলার পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়নের আমতৈল গ্রামে অবস্থিত ‘বন্ধু পোলট্রি ফার্ম’ এ বেআইনিভাবে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করে তাণ্ডবলীলা চালায়। এ সময় বাধা দিলে ফার্মের মালিক দীনবন্দু সেনকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। এতে খামার মালিকের আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি সাধন হয়।
এছাড়া স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহজাহান মিয়ার বাড়িতে থাকা প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে প্রাপ্ত ধান কাটার হারভেস্টার মেশিনের যন্ত্রপাতি ভাঙচুর, লুটপাট করা হয়। হামলার ঘটনায় বিশাল গণজমায়েত করে করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সংকটময় মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটানো হয়।
এসব অভিযোগ/অপরাধের কারণে কেন তাঁকে (উপজেলা চেয়ারম্যান) উপজেলা পরিষদ আইন-১৯৯৮ (সংশোধিত-২০১১) এর ১৩ ধারা অনুযায়ী কেন তাঁকে স্বীয় পদ হতে অপসারণ কার্যক্রম শুরু করা হবে না মর্মে কারণ দর্শানো হয়। সেই চিঠির প্রেক্ষিতে গত ১২ মে উপজেলা চেয়ারম্যান মোঈদ ফারুক স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে কারণ দর্শানোর জবাব দাখিল করেন। কিন্তু মন্ত্রণালয়ে পাঠানো তাঁর কারণ দর্শানোর জবাব অসন্তোষজনক বলে প্রমাণিত হয়।
এমতাবস্থায় উপজেলা চেয়ারম্যান মোঈদ ফারুকের বিরুদ্ধে আনীত অপরাধের কারণে উপজেলা পরিষদ আইন-১৯৯৮ (সংশোধিত ২০১১) এর ১৩ ধারা অনুযায়ী তাঁকে তাঁর স্বীয় পদ হতে অপসারণের লক্ষ্যে উপজেলা পরিষদের সদস্য ও নারী সদস্যদের (অপসারণ, অনাস্থা ও পদ-শুন্যতা) বিধিমালা, ২০১৬ অনুযায়ী সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয় সিলেট বিভাগীয় কমিশনার মো. মশিউর রহমান এনডিসিকে।
এদিকে উপজেলা চেয়ারম্যান মোঈদ ফারুককে প্রধান আসামিসহ আরো ১২ জনকে অভিযুক্ত করে পোলট্রি খামারে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় খামার মালিক দীনবন্ধু সেন বাদী হয়ে জুড়ী থানায় মামলা দায়ের করলেও এখন পর্যন্ত কোনো আসামি ধরতে পারেনি জুড়ী থানা পুলিশ।
স্থানীয়দের মতে, উপজেলা চেয়ারম্যান মোঈদ ফারুক এলাকায় খুবই প্রভাবশালী ও মদ্যপায়ী ব্যক্তি হিসেবে অধিক পরিচিত। দিন কিংবা রাতে মদ্যপান করা যার নেশা। বিভিন্ন সময়ে উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ কর্তৃক উপজেলা চেয়ারম্যান এম এ মোঈদ ফারুকের বিরুদ্ধে যে প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয় সেখানে তাঁর মদপানের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। যার অসংখ্য তথ্য প্রমাণাদি রয়েছে।
চেয়ারম্যান মোঈদ ফারুকের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ব্যাখ্যা চাওয়ার পর তাঁর দেওয়া জবাব কর্তৃপক্ষের কাছে সন্তোষজনক বলে বিবেচিত না হওয়ার কারণে বিষয়টি বিভাগীয় কমিশনার সরেজমিন এসে তদন্ত করার কারণে সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি হয়েছে।
সবাই আশা করছেন, সরকারের মাঠ প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা, বিভাগীয় কমিশনার মো. মশিউর রহমান এনডিসির মাধ্যমে ঘটনার সুষ্ঠু ও সঠিক তদন্তের মাধ্যমে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে, এমন চিন্তায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছেন জুড়ীর সর্বসাধারণ। আর যদি এই তদন্তে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না হয় তাহলে খামার মালিক দীনবন্ধু সেনের শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক ক্ষতির দায়ভার কে নেবে? এই ঘটনায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না পেলে সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রতি মানুষ আস্থা হারাবে এবং জুড়ীতে দিন দিন অপরাধ প্রবণতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছেন অনেকেই।
উল্লেখ্য, গত ২ মে শনিবারকালের খবর র অনলাইনে ‘মাতাল উপজেলা চেয়ারম্যানের তাণ্ডব’ ৩ মে ‘সেই মাতাল উপজেলা চেয়ারম্যানকে প্রধান আসামি করে মামলা’ ৬ মে ‘সেই উপজেলা চেয়ারম্যানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ’ ২২ মে ‘সেই চেয়ারম্যানকে অপসারণে তদন্তের জন্য বিভাগীয় কমিশনারকে মন্ত্রণালয়ের চিঠি’ ও ‘জুড়ীর সেই উপজেলা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু আজ’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হলে দেশ-বিদেশে নেট দুনিয়ায় মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।